১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদ আইনের সূচনা। সেই আইনের কবলে পড়ে বর্ধমানের শস্যশ্যামল জনপদ ছেড়ে যেতে হয়েছিল শেষ রাজা উদয়চন্দকে। সেটা পরের বছর অর্থাৎ ’৫৫র ঘটনা। মাঝখানে, স্বাধীনতার আগে, ১৯৩৬–এ রাজা উদয়চন্দ নির্দল প্রার্থী হিসেবে ল্যাজিসলেটিভ কাউন্সিলের ভোটে জিতেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী গান্ধীবাদী বিজয়কুমার ভট্টাচার্যকে হারিয়ে। তারপর স্বাধীনতা এলো। এলো প্রথম বিধানসভা ভোট। ১৯৫২ সালে রাজা থাকা অবস্থাতেই তিনি ফের দাঁড়িয়েছিলেন বিধানসভা ভোটে। কিন্তু এবারে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে। বিরুদ্ধে সিপিআইয়ের বিনয় চৌধুরী। সেই বিনয় চৌধুরী যিনি পরের দিকে বামফ্রন্টের মন্ত্রী হয়েছিলেন বেশ কয়েক দশক জুড়ে।

এই বিধানসভা ভোটের সময় মানুষের ‘নার্ভ’ সেভাবে বুঝতে পারেননি রাজা। ভোট লড়তে যান রাজকীয় ঢংয়ে । মানে, তিনি বসে রইলেন প্রাসাদের অভ্যন্তরে। তাঁর হয়ে প্রচার চালালেন রাজকর্মচারিরা। তাঁদের সঙ্গে কংগ্রেস নেতারা। মানুষ এটাকে তেমন ভাল চোখে দেখলেন না। ভাবলেন, আগে তিনি ছিলেন নির্দল প্রার্থী। যেই কংগ্রেস ক্ষমতায় এলো, ওমনি রাজা চোখ–কান বুঁজে সে দলের নৌকায় উঠে পড়লেন! বাড়ি বাড়ি ঘুরে অক্লান্ত প্রচার চালানো বিনয়বাবু সেবার ভোটে জিতলেন। এই ঘটনায় রীতিমত আহতে হয়েছিলেন উদয়চন্দ। তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি, তাঁর কাছ থেকে এত উপকার পাওয়া প্রজারা এমনি করে তাঁকে হারিয়ে দেবেন!

কিন্তু এরই দশ বছর পরে পাশা পাল্টে দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী, বর্ধমানের শেষ রানি রাধারানিদেবী। তিনি ভোট লড়তে এসেছিলেন কংগ্রেসের হয়েই। এর পিছনে ছিল বিধান রায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ। তিনি প্রাসাদের ভেতরে বসে থাকবার মত ভুল করেননি। উল্টে গিয়েছিলেন মানুষের ঘরে ঘরে। বর্ধমানের প্রবীণ মানুষেরা মহারানির ভোটপ্রচারের দৃশ্যের কথা তারিয়ে তারিয়ে আজও বলেন। বলেন, ঘামতে ঘামতে গরমের ভেতর গোটা শরীর হীরের গয়নায় ঢেকে মহারানি দরজায় দরজায়। মেয়েরা, বাচ্চারা তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে দেখছে, জীবন্ত মানুষ না কি পুতুল? মানুষ কী করে এত সুন্দর হতে পারে! আর শুধু গ্ল্যামারের জোরেই দু’বারের বিধায়ক বিনয় চৌধরীর মত প্রার্থী হারলেন তাঁর কাছে। বিনয়বাবুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সেই প্রথম ও শেষ পরাজয়। রাধারানি জিতে বিধানরায়ের মন্ত্রীসভায় ঠাঁইও পেয়েছিলেন। তিনিই বর্ধমানের প্রথম মন্ত্রী।

আমরা আজ যে ঘটনার কথা আপনাদের জানাতে চলেছি, তা তারও বেশ কিছুদিন পরে। সন–তারিখের হিসেবে উদয়চন্দের পরাজয়ের ঠিক ২৩ বছর পরে, ১৯৭৫ সালের কথা। বিজয়চন্দের স্ত্রীর নামও ছিল রাধারানিদেবী। তিনি উদয়চন্দের মা। রাজমাতা রাধারানির মৃত্যু ঘটে বারানসীতে ৩০ জুন ১৯৬৩ সালে। তিনি বর্ধমান থেকে তার অনেক আগে, সম্ভবত বাংলা ১৩৩৭ সালের ১৩ আশ্বিন, বারানসীর গোপালভবনে স্বেচ্ছানির্বাসিত করেন নিজেকে। তাঁর অভিমানের কথা বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দেয়ালে গাঁথা রয়েছে। বারানসীতে রাজমাতার মৃত্যুর ১২তম বর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উদয়চন্দ যাবেন বারানসী, সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রণয়চন্দ। উদয়চন্দ বরাবারই সর্বত্র, বারানসীও যান বিমানযোগে। সেবার যাবার দিন ছিল বিমানধর্মঘট। ফলে বাধ্য হয়ে পিতা–পুত্রের ট্রেনযাত্রা। সেকালের আরও অনেক কিছুর সঙ্গে, এই ট্রেনযাত্রার বিবরণই গিরিধারী সরকারের কাছে দিয়েছিলেন প্রণয়চন্দ গত ১৭ জুলাই, ২০০৭–এ বর্ধমানের নতুনগঞ্জের রাধাবল্লভজিউ মন্দিরে বসে।

রাজা উদয়চন্দ রাজত্ব হারিয়ে, তার ওপর নির্বাচনে হারের ধাক্কায় খুবই ভেঙে পড়েছিলেন । তিনি সারাদিন চুপ করে বসে থাকতেন। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। কোনও কাজই তিনি করতেন না, যাকে বলে পুরোপুরি কর্মহীন। বলেছিলেন প্রণয়চন্দ। গিরিধারী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ আপনার বাবা উদয়চাঁদ, শোনা যায় ট্রেনে বর্ধমান পার সময় ক্ষোভে দুঃখে ট্রেনের জানলার ঢাকা নামিয়ে দিতেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরেই প্রণয়চন্দ বলেছিলেন, ‘ আমি ট্রেনের কামরায় বাবার সঙ্গে বসে বোধহয় খবরের কাগজ পড়ছি। হাওড়া থেকে বেনারস জার্নি। বর্ধমান কখন ঢুকেছে খেয়ালই করিনি। যখন বাঁকা নদী পেরোচ্ছে তখন ব্রিজের আওয়াজে তাকিয়ে দেখি বাবা চোখ বুঁজে আছেন, আর দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। এই অবস্থাটা আমি লক্ষ করলাম আসানসোল পার যতক্ষণ বর্ধমান(জেলা) ততক্ষণই চলল। উনি চোখ বুঁজে স্থির বসে, ঝরঝর করে দু্’চোখ বেয়ে জল পড়ছে।’ এতটাই জনপদ বর্ধমান আর তার মানুষদের ভালবাসতেন বর্ধমানের শেষ রাজা উদয়চন্দ!

শ্রীসরকারের মুখে আরও একটা গল্প শুনেছি। সেটা বিজয়চন্দের রেলের ওপরে বিস্তার করা মহাপ্রভাবের। রেলপথ বাংলার সীমা ছাড়িয়ে এগোতে এগোতে একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, রানিগঞ্জের কাছের সিয়ারশোলে হবে একটি জংশন স্টেশন। সেখানেও এক ব্যবসায়ি বংশ রাজা উপাধি পেয়েছে। তাঁদের দাবি পূরণে রেল সিয়ারশোলে জাংশন করতে উদগ্রিব। সব ঠিকঠাক। এই খবর পেয়ে বিজয়চন্দ রেগে আগুন। রেলের এই সিদ্ধান্ত সরাসরি তাঁর সম্মানে আঘাত করেছিল। তিনি সোজা গিয়ে কর্তৃপক্ষকে বললেন, কোনমতেই সিয়ারশোলে জংশন স্টেশন করা যবে না। কী করে বর্ধমানরাজের অধিকারের আওতায় থাকা একটি জনপদে রাজাদেরই অন্ধকারে রেখে জংশন হচ্ছে? জংশন যদি করতে হয়, তাহলে সেটা করতে হবে সবার আগে বর্ধমানে। বিজয়চন্দের ক্রোধের বহর দেখে রেলের কর্তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। সিয়ারশোলে জংশন তো দূরের কথা, কোনও স্টেশনই আর করা হলো না। আজও সিয়ারশোল গুরুবপূর্ণ রেলস্টেশন পায়নি। অথচ বর্ধমানের অদূরের অবস্থিত খানাও জংশনের মর্যাদা পেয়েছে।
সম্প্রতি বর্ধমানের রেলস্টেশনের কাছে পুরনো রোডওভার ব্রিজটিতে ভারি যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেই ব্রিজ নাকি ভবিষ্যতে আর থাকবে না। ভেঙে ফেলা হবে। শোনা যায়, ট্রেনযাত্রার আগে অতীতে এই ব্রিজের মাঝে এসে থামতো রাজাদের গাড়ি। সেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্রিজসংলগ্ন এক ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে আসতেন রাজা–রানিরা। তাঁদের সম্মানে বহনকারী সব ট্রেনই নাকি এসে থামতো ওই ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। পুরনো দিনের মানুষেরা এই ঘোরানো সিঁড়ি দেখেছেন দীর্ঘদিন পর্যন্ত। তারপর সে সিঁড়ি কোথায় গেল, কেউ জাননে না!
লেখক: রানা সেনগুপ্ত লেখক পরিচিতি: প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও প্রাক্তন সাংবাদিক ছবি: অজ্ঞাত প্রতিবেদনটি লেখকের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ বিস্মৃত ইতিহাসের খোঁজে’ থেকে সংগ্রহীত ইমেইল : [email protected]
3 কমেন্টস
অনেকদিন পরে খুব সুন্দর একটি লেখা| খুব ভালো লাগলো |
বাহ! বেশ সুন্দর পোস্ট। রানা বাবুর লেখনী খুবই সুন্দর।
Khub sundor lekha