আমরা জানি বর্ধমানের বিভিন্ন স্থান বিখ্যাত নানাবিধ কারণে। কিছু জায়গা বিখ্যাত মন্দিরের জন্য , আবার কিছু জায়গা বিখ্যাত মসজিদের জন্য । যেমন অরণ্য কোনো অঞ্চলকে বিখ্যাত করেছে , তেমনই নামকরা কিছু মিষ্টান্ন আবার কিছু জায়গাকে করেছে স্বতন্ত্র । কিন্তু কখনো শুনেছেন একটা ঘড়ি কোনো গ্রামের ঐতিহ্যের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে? এমনটাই হয়েছে কালনার অকালপৌষ গ্রামের সঙ্গে । একটা ঘড়ি অকালপৌষ গ্রামকে করে তুলেছে রীতিমত বিখ্যাত । হাওড়ার বড় ঘড়ির কথা তো শুনেছেন, বর্ধমানের এই ঘড়ির বয়সও কম নয়! চলুন সেই গল্প আজ শোনা যাক।

ছবি : সন্দীপ ঘোষ
অকালপৌষ গ্রামের বাসিন্দা অর্ধেন্দুশেখর ঘোষ মহাশয় ছিলেন ইংরেজ আমলের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপার । বিলিতি আদবকায়দায় অভ্যস্ত অর্ধেন্দুশেখরবাবু ছিলেন খুবই শৌখিন প্রকৃতির মানুষ । বিলিতি ঘড়ির প্রতি তাঁর ছিল অমোঘ আকর্ষণ । নিজের গ্রামের অমন অট্টালিকার ন্যায় সুবিশাল বাড়িতে একটি সুন্দর ঘড়ি লাগানোর কথা তাঁর মাথায় ঢুকলো । ব্রিটিশ আমলে ইংলান্ডের “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানি ছিল ডাকসাইটে ঘড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা। আনুমানিক ১৮৯৫ সালে অর্ধেন্দুশেখর বাবু “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানিকে একটা বড় মাপের ঘড়ির বরাত দিলেন । লম্বায় আট ফুট আর চওড়ায় আড়াই ফুট মাপের সুবিশাল দৈতাকৃতির ঘড়িটি একশ পঁচিশ বছর আগে কিনতে দাম পড়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা । এটি তখনকার দিকে মোটেও মুখের কথা ছিল না ।

ছবি : সন্দীপ ঘোষ
যাইহোক, এমন ডাকসাইটে ঘড়ির গর্বে গর্বিত অর্ধেন্দুশেখরবাবু ঘড়ি বগলদাবা করে গ্রামের বাড়ি এলেন । মাটি থেকে প্রায় তিরিশ ফুট উচ্চতায় সেই ঘড়ি দোতলা বাড়ির কার্নিশে এমন জায়গায় লাগালেন যাতে দুদিক থেকে ঘড়িটি দেখা যায় । ঘড়িটির তিনটি মুখ । একটি বাড়ির ভিতরের দিকে, অন্যদুটি মূল রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে । লোহার বর্ম দিয়ে ঘেরা ঘড়ির ভিতরের সব যন্ত্রাংশ উন্নতমানের বিলিতি পিতল দিয়ে তৈরী । ঘড়ির কাঁটায় খোদাই করা আছে অর্ধেন্দুবাবুর নামের আদ্যাক্ষর ‘এ এস জি’। গ্রামের মানুষ এমন ঘড়ি বাপের জম্মে কখনো দেখেনি । গ্রামের কিছু মাতব্বররা ঘড়িটির তিনটি মুখ দেখে রসিকতা করে নামকরণ করলেন ‛ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ‘। লোকের মুখে মুখে ঘড়ির মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে । দূরদূরান্ত থেকে লোকে উপচে পড়তে লাগলো ঘড়ির দর্শন করতে । রাতারাতি অকালপৌষ হয়ে গেল ভি আই পি গ্রাম ।

ছবি : সন্দীপ ঘোষ
জানা গেছে, ১৮৯৫ সালের পর থেকে আপন গতিতে অবিরাম চলছে এই ঘড়ি। গ্রামের মানুষের দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এই ঘড়ি। সময় দেখে চাষে যাওয়া, ছোটোদের স্কুলে যাওয়া সবই এই ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে। পনেরো দিন অন্তর দম দিতে হয় এই ঘড়িতে । অর্ধেন্দুবাবুই ১৫ দিন অন্তর এই দম দেওয়ার কাজ করতেন। তারপর তাঁর ছেলে , এখন তাঁর নাতি তনুময় । একবারের জন্যও ভোলেননি কেউ। অর্ধেন্দুশেখরবাবুর বংশধরেরা পুত্রস্নেহে লালন পালন করেন এই ভি আই পি ঘড়িটিকে। বর্তমান বংশধরদের মুখে শোনা গেল যে, অর্ধেন্দুবাবুর মৃত্যুর পরে নাকি এক বিদেশী সাহেব এই ঘড়িটি কিনতে এসেছিলেন । তিনি নাকি এক কোটি টাকা দামও দিয়েছিলেন । কিন্তু অর্ধেন্দুবাবুর পুত্র ঘড়ি বিক্রি করতে রাজি হন নি । তিনি সাহেবকে মিষ্টি জল খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন । ঘোষ বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যদের বক্তব্য , “এই ঘড়ি আমাদের বংশ পরিচয়ের অন্যতম গৌরব”। পর্যটকরা কালনার মন্দির মসজিদ দর্শনের পরে হাতে সময় পেলে ঘুরে যান ‘বড় ঘড়ি’র গ্রাম এই অকালপৌষ। অর্ধেন্দুবাবুর খেয়ালে কেনা ঘড়ি বদলে দিল একটা গ্রামের পরিচিতি।

ছবি : সন্দীপ ঘোষ
অর্ধেন্দুশেখরবাবুর নাতি তনুময় জানান, এই ঘড়ি তাঁর দাদু ও বাবার ঐতিহ্য , গ্রামের মানুষের গর্বের কারণ । দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এই ঘড়িটি দেখতে আসেন। সারা বাংলায় এরকম ঘড়ি আর আছে কিনা আমার জানা নেই।
কিভাবে যাবেন অকালপৌষ?
*************************
বর্ধমান থেকে ট্রেনে মেইন লাইন লোকাল ধরে বৈঁচী স্টেশনে নামুন । ওখান থেকে কালনাগামী বাস ধরে শিরীষতলা মোড় স্টপেজে নামুন । ট্রেকার বা টোটো ধরে পৌছে যান অকালপৌষ । কালনাগামী দু একটি বাস ( ভায়া আনুখাল) অকালপৌষ গ্রামের উপর দিয়েই যায়।

ছবি : সন্দীপ ঘোষ
উপস্থাপন: দিব্যসুন্দর কুন্ডু ছবি : সন্দীপ ঘোষ ( অর্ধেন্দুবাবুর ভাই পশুপতিবাবুর নাতি ) তথ্য সহায়তা : সন্দীপ ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা , প্রতিদিন , এবেলা ইমেইল : [email protected]
1 কমেন্ট
এমন সুন্দর একটি ঐতিহাসিক ঘড়ির সংবাদ শুনে খুব ভালো লাগলো